রাজশাহী মহানগরীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে ভদ্রামোড় পর্যন্ত কোটি টাকা খরচে নির্মিত মহাসড়কটি মাত্র ২ বছর যেতে না যেতেই খানাখন্দে ভরা বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে, যার ফলে হরহামেশাই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা বিপন্ন হচ্ছে।
এই রাস্তাটি ২০০৭ সালে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) দ্বারা ২-লেন বিশিষ্ট করে নির্মিত হয় এবং পরবর্তীতে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক) দ্বারা গত বছর ৪-লেন বিশিষ্ট করে পুননির্মাণ করা হয়, যাতে উভয় পাশে ড্রেনও যুক্ত করা হয়। কিন্তু ২ বছর যেতে না যেতেই রাস্তার এমন বেহাল দশার কারণে প্রশ্ন উঠেছে রাস্তা তৈরিতে কি পরিমাণ নিম্নমানের কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়েছিল?
রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) ভারপ্রাপ্ত প্রকৌশলী আব্দুলাহ আল মঈন বলেন, আমরা রাজশাহী শহরের এই সকল ভাঙ্গা ও ক্ষতবিক্ষত রাস্তার বিষয়ে অবগত আছি ইতিমধ্যে। আমরাও ওই রাস্তাগুলো দিয়ে চলাফেরা করি। এই রাস্তাগুলোতে ভারি যানবহন ও অতিবৃষ্টির কারণে খুব দ্রুত নষ্ট হচ্ছে, সেগুলো মেরামত করার জন্য উদ্ব্যেগ নিয়েছি। আমরা একটি দরপত্রের আহ্ববান ও করেছি। আগামী ২৮ আগস্ট এই দরপত্র ওপেনিং আছে। রাজশাহী শহরের প্রধান প্রধান সড়কের খানাখন্ডগুলো মেরামত করতে পারবো।
রাজশাহী উন্নয়ন কতৃপক্ষ (আরডিএ) এর ভারপ্রাপ্ত প্রকৌশলী বলেন, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে ভদ্রামোড় পর্যন্ত রাস্তাটি আমরা শেষ ২০০৭ সালে নির্মাণ করার পর সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করি। আমাদের কাজ রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করে দেওয়া, তবে মেরামত করা নই। এই মেরামতের কাজ সিটি কর্পোরেশন করে থাকে।
তিনি আরও বলেন, এই রাস্তাটি ২০০৭ সালে ২লেন বিশিষ্ট করে নির্মাণ করা হয় আরডিএ কতৃক। এরপর রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন গত বছর পুনরায় ৪ লেন বিশিষ্ট ও রাস্তার ২পাশে দিয়ে ড্রেন নির্মাণ করে। আমি ওই রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করি নিয়মিত। কিন্তু ১ বছর যেতে না যেতেই এমন বেহাল অবস্থা হওয়ার কথা ছিল না।
১৯ নং ওয়ার্ডের স্থানীয় বাসিন্দা সুমন বলেন, রাস্তার মাঝে এমন খানাখন্ডের কারণে প্রচুর সমস্য হয় আমাদের। এছাড়া প্রায় প্রতিদিন একটি না একটি মোটর-বাইক দূর্ঘটনার কথাও শুনতে পাই। বিশেষ করে বৃষ্টির সময় এই রাস্তায় বেশী দূর্ঘটনা ঘটে। এই যে খানাখন্ডগুলোতে পানি ভরে থাকার কারণে ড্রাইভাররা বুঝতে পারে না, এই গর্তের গভীরতা কত গাড়ি নামানো মাত্রই দূর্ঘটনার শিকার হতে হয় তাদের।
মোটর-বাইক চালক হাসান জানায়, আমার বাড়ি এই পাশেই। আমি প্রতিনিয়িত এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করার সময় খুব কষ্ট হয় এছাড়া প্রায় এই রাস্তায় দূর্ঘটনা ঘটে। গত শনিবার (১৬ আগস্ট) এই রাস্তার খানাখন্ডের জন্য একটি মোটর-সাইকেল দূর্ঘটনার শিকার হয়ে চালকের পা ভেঙ্গে গেছে ও আরহীর হাত-পা ছিলে গেছে। বর্তমানে তারা রামেক হাসপাতালে ভর্তি আছে ৩১ নং ওয়ার্ডে। এছাড়া এই রাস্তার এমন বেহাল অবস্থার কারণে প্রায় ২মাস আগে সাব্বিরের বাগানের সামনে সড়ক দূর্ঘটনায় পড়ে ৩৫ বছরের এক যুবক নিহত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা চাই সরকার যেন অতি দ্রুত এই খানাখন্ডে ভরা রাস্তা মেরামত করে আমরাদের রক্ষা করে।
রায়েম ট্রাভেলস এর এক বাস চালক জানায়, আমাদের সময়ের গাড়ি কিন্তু রাস্তার এমন বেহাল দশার কারণে আমরা সময়ে গাড়ি নিয়ে যেতে পারি না। এছাড়া রাস্তার এমন বেহাল দশার কারণে আমাদের গাড়ির ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, কখনো পাতি ভেঙ্গে যায় আবার কখনো চাকা পামচার হয়ে যায়।
হানিফ ট্রাভেলস এর এক বাস চালক জানায়, এই খানাখন্ড রাস্তা শুধু রাজশাহীতে নই বরং বগুড়া, কুষ্টিয়া, নাটোরেও একই অবস্থা। আমাদের সময়ের গাড়ি সময়ের মধ্যেই স্ট্যান্ডে পোঁছাতে হয়। বিধায় অনেক সময় গাড়ি জোরে চালানোর সময় এই সকল ক্ষত-বিক্ষত রাস্তায় পড়ে আমাদের গাড়ি ও যাত্রিদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। আমাদের সরকারে কাছে একটাই দাবি যাতে এই সকল রাস্তাগুলো দ্রুত মেরামত করা হয়।
বাংলাদেশে খারাপ রাস্তার কারণে প্রায় ১৫% সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। ২০২৩ সালে দেশে ৬,২৬১টি দুর্ঘটনায় ৭,৯০২ জন মারা গেছেন, যার মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩২.৪৩%। রাজশাহীতে বছরে গড়ে ৮-১০ জন দুর্ঘটনায় মারা যান, তবে আন্ডার রিপোর্টিংয়ের কারণে প্রকৃত সংখ্যা বেশি হতে পারে। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৫,৩৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার ৩৬.৪৮% জাতীয় মহাসড়কে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডঐঙ) ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে প্রায় ৩২,০০০ মৃত্যু হয়, যা জিডিপি’র ৫% ক্ষতির কারণ। রাজশাহীতে খারাপ রাস্তার কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্য, যা মোট দুর্ঘটনার ২৬.৮%।
এই বেহাল দশা জনজীবনকে বিপন্ন করছে এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়াচ্ছে। স্থানীয়রা দ্রুত মেরামতের দাবি জানিয়েছেন। দরপত্র খোলার পর মেরামত শুরু হলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য ভারী যানবাহন নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি।
মন্তব্য করুন